বর্তমানে তালাক একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিনত হয়েছে। এই তালাকের ফলে সবচেয়ে অসহায় যারা হয় তারা হলাে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে জন্ম গ্রহণ করা সন্তানরা। কারণ সন্তান যদি তার মায়ের হেফাজতে থাকে তাহলে সেই সন্তান তার বাবার আদর, স্নেহ, ভালােবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। যদি বাবার কাছে থাকে তাহলে সেই সন্তান তার মায়ের আদর, যত্ন, স্নেহ, ভালােবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। যার ফলে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাস সঠিকভাবে গড়ে উঠে না। তালাকের পরপরই যে প্রশ্ন টা চলে আসে তা হলাে সন্তান কার কাছে থাকবে? মায়ের কাছে? নাকি বাবার কাছে? চলুন দেখি আইন কি বলে?
মুসলিম আইন অনুযায়ী । নাবালক সন্তানের আইনগত অভিভাবক (legal guardian) হচ্ছে পিতা, আর মা হচ্ছে আইনগত তত্ত্বাবধায়ক (legal custodian)। বাংলাদেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী নাবালক সন্তান যদি ছেলে হয় তাহলে ০৭ (সাত) বছর পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে বা তত্ত্বাবধানে থাকবে। নাবালক সন্তান যদি কন্যা হয় তাহলে তার বয়ঃসন্ধি কাল পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে থাকবে। মায়ের যদি অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায় তৎক্ষেত্রে উল্লেখিত সময়কাল পর্যন্ত সন্তানকে হেফাজতে রাখার অধিকার মা হারাতে পারে। কারণ পরের সংসারে সেই সন্তান ভালাে নাও থাকতে পারে।
তবে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত বা রায় পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, মা যদি তার নতুন সংসারে সেই সন্তানকে নিজের হেফাজতে রেখে সঠিকভাবে লালন-পালন করতে পারে তাহলে সেই সন্তানকে মায়ের হেফাজতে দিতে আইনগত কোন বাধা নেই। বিজ্ঞ আদালতের নিকট যদি প্রতিয়মান হয় যে, সন্তান মায়ের কাছে থাকলে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাস স্বাভাবিক ভাবে হবে তাহলে উল্লেখিত সময়সীমার বাহিরে ও বিশুদ্ধ আদালত সন্তানকে মায়ের হেফাজতে দিতে পারেন।
পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫,
অনুযায়ী পারিবারিক আদালত গঠিত হয়। উক্ত আইনের ৫ ধারার বিধান মতে নাবালক সন্তানের অভিভাবক নিয়ােগের একচ্ছত্র অধিকার পারিবারিক আদালতের। অভিভাবক নিয়ােগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞ আদালত সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন নাবালক সন্তানের কল্যান (welfare of the child)
অর্থাৎ নাবালক সন্তান কার কাছে থাকলে সবচেয়ে ভালাে থাকবে এবং অন্যান্য পারিবারিক দিক বিবেচনা করেন যেমন, নাবালক সন্তানের বয়স, লিঙ্গ, ধর্ম এবং প্রস্তাবিত অভিবাবকের চরিত্র ও সামর্থ্য বিবেচনা করবেন। নাবালক সন্তান যদি ভালাে মন্দ বুঝার ক্ষমতা থাকে বা বুদ্ধিদিন্তের পরিচয় দিতে পারে সেই ক্ষেত্রে বিজ্ঞ আদালত নাবালক সন্তানকে তার খাস কামরায় নিয়ে তার মতামত নিতে পারেন এবং তার মতামতকে প্রাধাণ্য দিতে পারেন। সর্বপরি উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত ও প্রচলিত আইনে একটি বিষয়কেই প্রাধান্য দিয়েছেন সেটি হলাে নাবালক সন্তানের কল্যান (welfare of the child) যদি কোন নাবালক সন্তানের কেউ না থাকে তবে বিজ্ঞ আদালত নীজ বিবেচনায় অভিভাবক নিয়ােগ করেন।
নাবালক সন্তান যার কাছেই থাকুক না কেন পিতাকেই নাবালক সন্তানের ভরন-পােষন দিতে হয়। এমনকি তালাক ব্যতীত স্ত্রী যদি নাবালক সন্তানকে নিয়ে আলাদা থাকে সেই ক্ষেত্রে পিতাকেই ভরণ পােষন দিতে হয়। পিতা যদি নাবালক সন্তানের ভরন-পােষন দিতে অস্বীকার করে বা দিতে না চায় তাহলে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়েরের মাধ্যমে নাবালক সন্তানের ভরণ-পােষন আদায় করা যায়।
নাবালক সন্তান যদি মায়ের নিকট থাকে বাবা সন্তানের সহিত দেখা করিতে পারিবেন এমনকি চাইলে সপ্তাহে এক বা দুই দিন তার কাছে রাখতে পারবেন। মা যদি বাবাকে সন্তানকে দেখার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাহলে সে অভিভাবকত্ব হারাতে পারেন। পিতা পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করে নাবালক সন্তানের সহিত দেখা শুনার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। আমাদের প্রত্যেকের উচিৎ নাবালক সন্তানকে আদালতে টান হেছড়া না করে পারিবারিক ভাবে সুন্দর সমাধান করা যাতে করে প্রত্যেকটি শিশু সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করতে পারে এবং সুন্দরভাবে গড়ে উঠে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাস। ভালাে থাকুক সকল শিশু, ভালাে থাকুক সকল বাবা-মা।
মোঃ সোহেল রানা
এলএল.বি (অনার্স) এলএল.এম
এডভোকেট
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট